পুরো ফেসবুক জুড়ে একটাই প্রশ্ন, নারী কিসে আটকায়? জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতায় আটকালো না,বিল গেটসের টাকায় আটকালো না, তাহসানের কণ্ঠে আটকালো না ইত্যাদি…ইত্যাদি!
মানুষ যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় অটোমেটিক তার চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন হয়ে যায়। সেই সাথে তার স্রষ্টার প্রতি ও মনোনিবেশ করতে দেখা যায় তখন দুনিয়ার প্রতি লোভ লালসা কমে যায় আর আখেরাতের প্রতি চিন্তা ভাবনা বেড়ে যায়। সত্যিকারের মানুষের কাছে স্রষ্টা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা সবসময়ই থাকে। যখন দুনিয়ার প্রতি লোভ-লালসা থাকবে তখন তাকে আটকায় বা কে?সেটা নারী হোক বা পুরুষ হোক।
নারী হলো মহান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা নারীকে পুরুষের জীবন সঙ্গিনী হিসেবে মানব জীবন পরিচালনার জন্য পারস্পরিক সহযোগী করেছেন। ইসলাম মর্যাদার দিক দিয়ে নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন করে দেখেনি; বরং ইসলামের আগমনেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত নারী সমাজ পেয়েছে মুক্তির সন্ধান। সারা দুনিয়াতে যখন নারীরা নিদারুণ অবস্থায় কালাতিপাত করছিল; আরব, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে তাদের জন্তু-জানোয়ার বলে মনে করা হতো এবং মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করা হতো না, তখন ইসলাম নারীর যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে নারী জাতিকে সম্মানের সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। যেমন আল্লাহ তাআলা পুরুষদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)
আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের স্বীয় প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের একই আত্মা (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং ওই আত্মা থেকে তাঁর জোড়া (হাওয়া)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং এতদুভয় থেকে বহু নর ও নারী বিস্তার করেছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা পরস্পরের কাছে (স্বীয় হকের) দাবী করে থাক এবং আত্মীয়তা (এর হক বিনষ্ট করা) থেকেও ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকলের খবর রাখেন।’ (সুরা নিসা : ১)
শরিয়াহ বোর্ড ও অডিট বিষয়ক কতিপয় সুপারিশ
নারীর মর্যাদা বলতে নারীর ন্যায়-সঙ্গত অধিকারকে বুঝায়। আর অধিকার অর্থ প্রাপ্য, পাওনা ইত্যাদি। কারও অধিকার প্রদানের অর্থ হচ্ছে তার প্রাপ্য বা পাওনা যথাযথভাবে প্রদান করা। আর এ প্রাপ্য বা পাওনা বলতে তার অধিকারের স্বীকৃতি, কর্তব্যের সঠিক বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানের যথার্থ মূল্যায়নই বুঝানো হয়। সুতরাং নারী অধিকার বলতে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথা সকল ক্ষেত্রে নারীর যথার্থ মূল্যায়নকেই বুঝানো হয়।
ইসলাম পূর্ব যুগে নারী ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, লাঞ্চিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং অধিকার হারা জাতি। সে সময় নারীকে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বাজারের পণ্য হিসাবে গণ্য করা হতো। সেই সময়ে নারীদের মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হতো না এবং তাদের কোনো সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এমনকি মানব জাতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও ছিল না। তাদের প্রতি খুবই কঠোর আচরণ করা হতো। সে যুগে নারীদেরকে মনে করা হতো দাসী এবং ভারবাহী পশু হিসেবে। যাদেরকে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। সে আমলে স্বামী যত খুশি স্ত্রী গ্রহণ করত এবং ইচ্ছা করলে তার স্ত্রীকে অপরের কাছে বিক্রি করে দিতে পারত কিংবা স্ত্রীকে দিয়েই কেউ ঋণ পরিশোধ করত। আবার কেউ উপহার হিসেবে কাউকে এমনিই দিয়ে দিত। তারা কন্যা সন্তান জন্মকে লজ্জাজনক মনে করে স্বীয় নিষ্পাপ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠিত হতো না। তাদের এমন বিবেক বর্জিত কর্ম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ (সুরা তাকভীর : ৮-৯)
সেযুগে তারা পিতা-মাতা বা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হতো। পিতৃহীনা সুন্দরী-ধনবতী বালিকার অভিভাবক যথাযথ মোহর দানে তাকে বিবাহ করতে সম্মত হতো না। আবার অন্যত্র বিবাহ দিতেও অসম্মতি প্রকাশ করত। সুন্দরী বাদী দ্বারা দেহ ব্যবসা করিয়ে অর্থ উপার্জন করা হতো। এ গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন,‘আর তোমরা দুনিয়ার ধন-সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে তোমাদের যুবতী দাসীদের ব্যভিচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করবে না। যখন তারা পাপমুক্ত থাকতে চায়।’ (সুরা নুর : ৩৩)।
নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় ইসলামের ভূমিকা:-
মানব সৃষ্টির প্রথম দিকে আল্লাহ তাআলা আদি পিতা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর তাঁর সহধর্মিণী হিসেবে তাঁরই বাম পাঁজরের একটি হাড় থেকে আদি মাতা হাওয়া (আ.)-কে সৃজন করেন। অতপর তাঁদের থেকে অসংখ্য নর-নারী সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)
মহান আল্লাহ এ বিশ্ব জগতে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি বনি আদমকে সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে জলে ও স্থলে আরোহণ করিয়েছি এবং উত্তম বস্তুসমূহ প্রদান করেছি। আর আমি তাদের আমার বহু সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনি ইসরায়েল : ৭০)
ইসলাম নারীর প্রতি সকল প্রকার অত্যাচার, অবিচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করত নারীকে সর্বক্ষেত্রে অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে। ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর যে অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
নারী যখন মেয়ে:–ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, সন্তানরা আল্লাহর নিয়ামত। আর মেয়েসন্তানরা পুণ্য। মহান আল্লাহ নিয়ামতের হিসাব নেন, আর পুণ্যের প্রতিদান দেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদন করেছে, সেই কন্যাসন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় (প্রতিবন্ধক) হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯১৩)
নারী যখন বোন:- ইসলাম মেয়ে এবং বোনের সঙ্গেও সদাচরণ করার তাগিদ দিয়েছে। আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যারই তিনটি মেয়ে অথবা তিনটি বোন আছে, সে তাদের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করলে জান্নাতে যাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯১২)
নারী যখন অনাত্মীয়:-নারী অনাত্মীয় হলেও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামের সৌন্দর্য। তার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন থাকা সবার দায়িত্ব। ইসলামের ইতিহাসে নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় বনু কাইনুকা গোত্রের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এক সাহাবি তার মুসলিম বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় জীবন দিয়ে দিয়েছেন।
বিয়ের মাধ্যমে নারীর অধিকার ও মর্যাদা:-জাহেলি যুগে বৈবাহিক ক্ষেত্রে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। তারা শুধু পুরুষের ভোগের সামগ্রী ছিল। ইসলাম এহেন ঘৃণিত প্রথার মূলোৎপাটন করত নারী ও পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘তবে যেসব নারী তোমাদের পছন্দ হয়, তাদের মধ্য থেকে দুই দুই, তিন তিন, চার চার জনকে বিবাহ করো। কিন্তু তোমাদের মনে যদি আশঙ্কা জাগে যে, তোমরা তাদের সঙ্গে ইনসাফ করতে পারবে না। তাহলে একজন স্ত্রী গ্রহণ কর অথবা তোমাদের দাসীদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ কর। অবিচার থেকে বাঁচার জন্য এটাই অধিক সঠিক কাজ।’ (সুরা নিসা : ৩)
নারীকে স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা দান:-ইসলামের আবির্ভাবের আগে নারীদের পছন্দমত স্বামী গ্রহণের অধিকার ছিল না। ইসলাম নারীকে স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে বলপূর্বক কোনো নারীর স্বামী হতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে পুরুষরা! তোমরা মহিলাদের (স্বীয় স্বামী নির্বাচন করে) বিয়ে করাতে বাধা প্রদান করো না।’ (সুরা বাকারা : ২৩২)
স্ত্রী হিসেবে নারী:-ইসলাম পারিবারিক জীবনে নারীকে দিয়েছে তার ন্যায্য অধিকার। সংসার জীবনে নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। কোনো একজনের একক প্রচেষ্টায় সংসার জীবন পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম চরিত্রের অধিকারী, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আর আমি তোমাদের মধ্যে নিজ স্ত্রীদের কাছে উত্তম।’। (তিরমিজি, হাদিস : ৩২৫২)
Leave a Reply