এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং। ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে গ্রামটি সুপ্রাচীন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু জ্ঞানীগুনীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। আজ থেকে প্রায় বারো’শ বছর পূর্বে বানিয়াচং রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। এখানে রয়েছে প্রাচীন দর্শনীয় অনেক নিদর্শন। এর মধ্যে সাগরদীঘি বা কমলারানীর দীঘি অন্যতম।
ঐতিহাসিক সাগর দিঘী বা কমলারাণীর দিঘীর নাম শুনেননি এমন লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে খুব কমই আছেন। এর আয়তন প্রায় ৬৫ একর, বানিয়াচং রাজধানীর প্রতিষ্ঠাতা কেশব মিশ্রের অধঃস্তন পুরুষ রাজা পদ্মনাভ এই বিশাল দিঘী খনন করান। প্রজাদের জলতেষ্টা নিবারণের লক্ষ্যে এই দিঘী খনন করা হয়।
জনশ্রুতি আছে, দিঘী খননের পর যখন ঐ দিঘীতে পানি উঠেনি তখন রাজা পদ্মনাভের কাছে দৈববাণী আসে -‘পদ্মনাভ, তোমার ঐ দিঘীতে জল উঠবে না, যে পর্যন্ত না রাজ পরিবারের কোন সতীসাধ্বী এই দিঘীতে আত্মত্যাগ করবে’। পরপর তিনদিন স্বপ্ন দর্শনে ঐ বাণী আসার পর ঘটনাটি তিনি রাণী কমলাবটিকে খুলে বলেন। রাণী সঙ্গে সঙ্গে নিজে আত্মত্যাগ করার পূর্ণ বাসনা ব্যক্ত করেন রাজার কাছে। রাণী ডুবে যাওয়ার পর বেশ কিছুকাল পর্যন্ত গভীর রাতে সোনার নৌকা, সোনার বৈঠা হাতে তাকে দিঘীর চারপাশে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
এই দীঘিকে পর্যটনে রূপান্তর করতে এলাকাবাসীসহ ভ্রমণপিপাসুরা দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছেন। ১৯৯৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় এল আর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় বানিয়াচংয়ের এই সাগরদীঘিকে পর্যটনকেন্দ্র করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বানিয়াচংবাসীর একমাত্র দাবি ছিল, কমলারানীর দীঘিকে পর্যটনকেন্দ্র করার। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জনসভায় সেই দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান সরকারের বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী এমপি ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর এই সাগরদীঘি পরিদর্শনে আসেন। সেখানে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আশ্বাস দ্রুতই বাস্তবায়ন করা হবে।
কিন্তু সরকারের সঙ্গে সাগরদীঘির চারপাড়ের মানুষের মামলা থাকায় সরকারপক্ষ সামনে এগোতে পারেনি। সুপ্রিমকোর্টের আপিল ডিভিশনে সেই মামলার রিভিউর আবেদন জানিয়েছিলেন চারপাড়ের বাসিন্দারা হবিগঞ্জের আর এম (রাজস্ব) শাখা ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যে মতে সেই রিভিউ শুনানি বর্তমানে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যে কোনো একদিন শুনানি শেষ হতে পারে বলে জানা গেছে।
বানিয়াচংয়ের এই সাগরদীঘি নতুন প্রজন্মের কাছেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় সারা বছরই সাগরদীঘি পরিদর্শনে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসেন। বর্তমান সরকারের সময়েই যাতে প্রধামন্ত্রীর দেওয়া আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়, সেই আশা করছেন বানিয়াচংবাসী তথা ভ্রমণ পিপাসুরা।
বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ্মাসন সিংহ এই বিষয়ে জানান, সাগরদীঘি পাড়ের বাসিন্দাদের মামলা চলমান থাকায় সামনের দিকে এগোনো যাচ্ছিল না। সুপ্রিমকোর্টে রিভিউ আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে, আশা করছি খুব তাড়াতাড়িই সাগরদীঘিকে পর্যটনে রূপান্তর করতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সেই আশ্বাস বাস্তবে প্রতিফলন ঘটবে।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান, বর্তমানে বানিয়াচং সাগরদীঘিটি সরকারের পক্ষ থেকে লিজ দেওয়া আছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটি যেন বাস্তবায়ন করা যায়, সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
Leave a Reply