আত্মশুদ্ধি অর্থ নিজেকে সংশোধন করা, অন্তরকে পাকপবিত্র করা। আরবিতে একে ‘তাজকিয়া’ বা ‘তাজকিয়াতুন নাফ্স’ বলা হয়।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয়, (সুরা আল-আ’লা : ১৪)।’ আলোচ্য আয়াতে ঈমানগত ও চরিত্রগত শুদ্ধি এবং আর্থিক জাকাত প্রদান সবই অন্তর্ভুক্ত।
আমরা যে ধনসম্পদের জাকাত আদায় করি, সেই ‘জাকাত’ শব্দের অর্থ শুদ্ধ করা। নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত’ এগুলো ফরজ কিন্তু আত্মশুদ্ধিও যে ফরজ তা অনেকেই জানি না।আত্মশুদ্ধি ব্যতীত আল্লাহর সব আদেশ নিষেধ মেনে চলা সম্ভব নয়। সাহাবায়ে কেরামগণ ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কতরকম জঘন্য কাজে জড়িত ছিল; ইসলাম গ্রহণের পর আত্মশুদ্ধি করে তারাই হয়ে গেছেন সোনার মানুষ অর্থাৎ পূতপবিত্র।
বর্তমানে সারা বিশ্বে যত মারামারি, হত্যা, অশান্তি অরাজকতা’ সবকিছুর মূলে রয়েছে একে অন্যকে দোষারোপ করা। আমরা মনে করি আমি ভালো, সে খারাপ। আমরা যদি অন্যের দোষ বর্ণনা করতে শুরু করি তাহলে সহজে শেষ করতে চাই না। কিন্তু নিজের দোষের দিকে ভুলেও তাকাতে চাই না; যার ফলে শুরু হয় ঝগড়া, গীবত বা অভিযোগ। আমরা যদি আত্মশুদ্ধি করি তাহলে নিজের দোষ দেখতে পাব। অন্যের দোষ খুঁজে পাব না। তখন দুনিয়াটা শান্তি আর স্বস্তিতে ভরে উঠবে। আত্মশুদ্ধি করলে আমাদের অন্তরের ব্যাধিসমূহ যেমন- রাগ, হিংসা, অহংকার, দুনিয়ার মোহ দূর হয়। আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বা মুমিন হওয়ার জন্য কতগুলো শর্ত আছেঃ-
১. যারা তাদের নামাজে বিনয়ী।২. যারা অহেতুক (অপ্রয়োজনীয়) বিষয় থেকে বিরত থাকেন।৩. যারা জাকাত দেন, (সুরা মুমিনুন :১-৪)।
আর এ সুরার চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যারা জাকাতের ওপর আমল করে তারা মুমিন।’ এ আয়াতের দুটি অর্থ’ একটি হলো ধনসম্পদের জাকাত দেওয়া আর দ্বিতীয় অর্থ হলো নিজের স্বভাব চরিত্রকে পাকপবিত্র করা অর্থাৎ আত্মশুদ্ধি করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিভিন্নভাবে আত্মার পরিশুদ্ধির কথা বলেছেন। যেমন, ‘সে সফলতা লাভ করল যে ‘তাজকিয়া’ (আত্মশুদ্ধি) করল। আর সে ব্যর্থ হলো যে নিজেকে কলুষিত করল, (সুরা: শামস- ৯-১০)।’ ‘নিশ্চয় সফল হবে সে, যে নিজেকে শুদ্ধ করবে, (সুরা আলা : ১৪)।’ আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ভালো করে শুনে নাও। নিঃসন্দেহে দেহের মধ্যে একটি মাংসপি- রয়েছে, তা ঠিক হলে পুরো দেহ ঠিক হয়ে যায়। আর তা খারাপ হলে পুরো দেহ খারাপ হয়ে যায়। খুব ভালো করে শোনো, সেই মাংসপি-টিই হলো ‘কলব’ বা আত্মা। আত্মা অসুস্থ বলেই ভালো কাজে মন বসে না। আত্মার ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। তাহলেই ভালো কাজে মন বসে, মনে প্রশান্তি আসে, জীবন সার্থক হয়। আর এ চিকিৎসাকেই আত্মশুদ্ধি বা আত্মার চিকিৎসা বলে। এ চিকিৎসার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাছে যেতে হবে, তাদের সঙ্গে মিশতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তাকওয়া অবলম্বন কর। আর তাকওয়া অবলম্বনের সহজ পন্থা হলো সাদিকিন অর্থাৎ মুত্তাকিদের (কামেল মুর্শেদ/পীর/সদ গুরু)সঙ্গে থাকা, (সুরা আত-তাওবাহ্ : ১১৯)।’ তাকওয়ার অর্থ ভয় করা, গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আর মুত্তাকি (কামেল মুর্শেদ/পীর/সদ গুরু) অর্থ যে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। এ ছাড়া সুরা ফাতিহাতে এসেছে যেসব মানুষ আপনার নিয়ামত বা অনুগ্রহ লাভ করেছে আমাদেরকে তাদের পথ দেখান। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই আয়াতে বলে দিয়েছেন যে, ‘যদি সিরাতে মুস্তাকিম (সফল পথ) চাও তবে ওইসব লোকদের তালাশ করে তাদের পথ অবলম্বন কর। কেননা, রাসুল (সা.) চিরকাল অবস্থান করবেন না। তাই নিয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহীন বা সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। কারণ, কেয়ামত পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব দুনিয়াতে থাকবে। মানুষের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কেবলমাত্র কিতাব পড়ে অর্জিত হয় না। বরং দক্ষ ব্যক্তির সাহচর্যের মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়। আমরা এখন নবী রাসুল, সাহাবি বা তাবেয়িদের মতো সোনার মানুষ পাব না। তাই বলে আমরা যদি মনে করি তাদের মতো মানুষ তো এখন নেই, তাই কারো কাছে যাব না’ সেটা হবে মারাত্মক ভুল। এখনতো আপনি কোনো কিছুই খাঁটি পাবেন না। খাবারে ভেজাল, মানুষে ভেজাল, জিনিসে ভেজাল’ সব কিছুতেই ভেজাল। তাই কি আমরা সব কিছু বাদ দিয়ে দিয়েছি। আগের মতো আন্তরিক ও দক্ষ ডাক্তার নেই তাই কি আমরা দেহের অসুখ হলে ডাক্তার দেখানো বাদ দিয়ে দিয়েছি? তাহলে আমরা কেন আমাদের অন্তরের চিকিৎসা থেকে দূরে থাকব? শয়তান আমাদেরকে এ পথ থেকে দূরে রাখতে চায়। তাই আমাদেরকে শয়তানের জাল ছিন্ন করে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের খুঁজতে হবে এবং তাদের পথে থাকতে হবে। এ পথে চলতে গিয়ে এবং ভালো কিছু পেতে হলে কঠোর সাধনা এবং ধৈর্যের দরকার।
বোখারি শরিফের একটি হাদিসের সারমর্ম, ‘এক ব্যক্তির ৯৯ জন মানুষকে খুনের পর অনুশোচনা হলো এবং সে একজন আলেম খুঁজে তার কাছে বলল, আমি এখন ভালো হতে চাই। আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন কী? অজ্ঞ সেই আলেম তাকে নিরাশ করে বললেন, না, আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন না। ওই ব্যক্তি উত্তর শুনে ওই আলেমকে খুন করে। খুনের সংখ্যা ১০০ হলো। তারপর সে অনুতপ্ত হয়ে আরো বড় আলেমের সন্ধান পেয়ে গেল! এই আলেম তাকে বলল, আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন। তবে শর্ত হলো তোমাকে তওবা করতে হবে এবং খারাপ কাজ বাদ দিয়ে সুন্দর পথে আসতে হবে।হাদিস শরিফে আছে, ‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ অহংকার এমন একটি সুক্ষ বিষয়, যা আমাদের অন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
আমরা বুঝতে পারি না, আমার অন্তরে অহংকার আছে। যা আমাদেরকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে। আত্মার চিকিৎসকের কাছে গেলে এ রোগ ধরা পড়ে। আমরা যে কোনো ব্যক্তির ওপর হঠাৎ করে রেগে যাই; এ রাগ আসলে অহংকার থেকে আসে। অহংকার না থাকলে মানুষ ক্রোধে ফেটে পড়বে না। আর নিরহংকার ব্যক্তি কখনোই নিজেকে অন্যের চেয়ে ভালো এবং মর্যাদাবান ভাববে না। নবী, রাসুল এবং সাহাবিদের কথাতো অনেক ঊর্ধ্বে, পরবর্তী যুগের বুজুর্গরাও ছিলেন নিরহংকার। তারা কারো দ্বারা কষ্ট পেলে সেটাকে নিজের অপরাধের শাস্তি মনে করে খুশি হতেন।
বিখ্যাত অলি হজরত জুননুন মিসরি (র.) একদিন কোথাও যাচ্ছিলেন। এক লোক তাকে অযথা কষ্ট দিতে হজরত যুননুন (র.)-এর মাথায় লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করল। তখন হজরত যুননুন (র.)-এর মুখ থেকে যে কথাটি বের হয়েছিল, ‘পেটাও এ মাথাকে। কারণ এ মাথা বহুদিন আল্লাহর নাফরমানি করেছে।’ আরেকটি ঘটনা’ একবার মিসরে মারাত্মক অনাবৃষ্টি দেখা দিল। তখন হজরত যুননুন (র.)-এর নিকট কিছু লোকজন এসে তাকে বলল’ হুজুর, বৃষ্টির জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করুন। তখন তিনি বললেন, ‘এ খরা মানুষের পাপাচারের ফল। আর আমার চেয়ে কঠিন পাপী এই জনপদে কেউ নেই। আমি শিগগিরই এখান থেকে চলে যাব। তখন আল্লাহ তায়ালার রহমত এসে বৃষ্টি নামায়।’ এসব গুণাবলি নিজে নিজে অর্জন সম্ভব নয়। তাই আমাদেরকে আত্মশুদ্ধির পথ গ্রহণ করতে হবে। তাফসিরে মারেফুল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যতদিন আত্মশুদ্ধি করানোর জন্য কাউকে না পাওয়া যায়, ততদিন প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ২০ বার করে ইস্তেগফার করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
এম,এ,কাদির বাবুল
Leave a Reply